ঢাকা: ‘একতরফা’ নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে তাকে ‘অবৈধ’-অগণতান্ত্রিক’ উল্লেখ করে ‘রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রাখা’র ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরদিন গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দুপুরে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান এই ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, ‘‘ বিএনপি এবং গণতন্ত্রের পক্ষে ৬৩ টি রাজনৈতিক দলের বক্তব্য আজকে অত্যন্ত স্পষ্ট… এই সরকারের অবৈধ, অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক যে ব্যবস্থাপনা সেটাকে জনগন সরাসরি গতকাল প্রত্যাখান করেছে। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ যে পর্যায়ে বৈধতা দেবার যে করেছিলো সেটা কিন্তু আজকে দেশে-বিদেশে সকলের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে।”
‘‘ আগামীতে তারা(ক্ষমতাসীনরা) যা কিছু চিন্তা করছেন যদি তারা ক্ষমতার বলে বন্দুকের নলে নির্ভর করে তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার প্রচেষ্টা বা দীর্ঘায়িত করার প্রচেষ্টা করেন তাহলে কিন্তু তারা বাংলাদেশের মানুষ শুধু নয়, সারা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে তারা অবৈধ, অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক হিসেবেই বিবেচিত হবেন। সুতরাং জনগনের ইচ্ছায় জনগনের ভোটে নির্বাচিত জবাবদিহি সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত জনগন আন্দোলন-সংগ্রাম রাজপথে অব্যাহত রাখব এবং সেই আন্দোলন-সংগ্রাম হবে শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক। ”
মঈন খান বলেন, ‘‘ আমরা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে আবার নতুন করে বলতে চাই, বিএনপির একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দল…আমরা লগি-বৈঠার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। আমরা অন্যায়ভাবে কারো গায়ে হাত দেই না। আমরা শান্তিপূর্ণ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আপনারা দেখেছেন আমাদের যে পর্যায়টি শেষ হয়েছে.. আমরা প্রতিটি বিভাগ থেকে শুরু করে প্রতিটি জেলা-উপজেলা এবং সর্বশেষ বাংলাদেশের প্রায় ৬০ হাজার ইউনিয়ন পরিষদের আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ সভা, মিছিল, প্রতিবাদ সভা এবং পদযাত্রা দিয়েছিলা। এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, বিএনপি জনগনের সঙ্গে থেকে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় এই সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে চায় এবং একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষ যাকে খুশি তাকে ভোট দেবে… সেই ভোটের মাধ্যমে পরবর্তিতে এদেশের জনগনের সত্যিকার প্রতিনিধিদের একটি সরকার গঠিত হবে, কোনো ডামি প্রতিনিধি দিয়ে নয়।”
‘‘ আমরা নতুন করে আহ্বান জানাব… এদেশের মানুষ তাদের নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তারা এই বর্তমান বাংলাদেশে স্বৈরাচারী যে অবস্থা সেই অবস্থার তারা পরিবর্তন ঘটাবে। বিএনপি জনগনের দল, বিএনপি জনগনের শক্তিতে বিশ্বাস করি এবং এই জনগনকে সম্পৃক্ত করে জনগনকে সঙ্গে নিয়ে আমরা রাজপথে নেমেছি জনগনের অধিকারের ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে। সেই আন্দোলনে আমরা রাজপথে ছিলাম, আমরা রাজপথে আছি এবং আগামীতে আমরা রাজপথে ছিলাম যতদিন না সত্যিকার অর্থে জনগনের অধিকার আমরা জনগনের হাতে তুলে দিতে পারব.. এটাই এই বিএনপির প্রতিজ্ঞা।”
৭ জানুয়ারি ভোট বর্জনের জন্য দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে মঈন খান বলেন, ‘‘ গতকাল ভোটাররা যে কাজটি করেছেন তারা বিদ্যমান আওয়ামী লীগের এই একদলীয় বাকশাল সরকারকে তারা বয়কট করেছে। দেশের মানুষ ভোট দিতে যায়নি। ভোট বর্জন করে জনগন গণতন্ত্রকামী বিরোধী দলগুলোর প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছে। আমরা তাদের অভিনন্দন জানাই।”
‘‘ এখানে একথা বলা যায় যে, সাধারণ মানুষ তো অনেক হিউমার করে …. আগামীতে সরকার যে চিন্তাভাবনা করছে নতুনভাবে, যে সরকার গঠন করবে এই ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে। সেটা আমরা এভাবে বলতে পারি, এই ধরনের ‘অব দ্যা ডমি, বাই দ্যা ডামি, ফ্রম দ্যা ডামি’। পরনির্ভরশীল ডামি সরকার নয়। জনগন প্রত্যাশা করে জনগনের সুষ্ঠু নির্বাচনে একটি জনপ্রতিনিধিত্ব সরকার যেজন্য ৫২ বছর আগে গণতন্ত্রকামী মানুষ এই দেশ সৃষ্টি করেছিলো।”
‘কর্মসূচি: সারাদেশে গণংযোগ’
মঈন খান বলেন, ‘‘ আমরা শান্তিপূর্ণ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তারই ধারাবাহিকতায় আগামীকাল থেকে আমরা পরবর্তি কর্মসূচি না দেয়া পর্যন্ত আমরা গণসংযোগ অব্যাহত রাখব।রাজপথে হাটে-ঘাটে আমরা মানুষের কাছে যাব, তাদের সাথে কথা বলব এবং তাদের কাছে লিফলেট বিতরণ করব। গনসংযোগের মাধ্যমে আমরা গণসচেতনতা সৃষ্টি করব, সেই সচেতনতা হচ্ছে গণতন্ত্রের সচেতনতা, মানুষের যে অধিকার প্রশ্নের মানুষের অধিকার পুণঃপ্রতিষ্ঠার সচেতনতা। আমরা আগামীকাল ও পরুশ এই কর্মসূচি অব্যাহত রাখব। তার পরে আমরা জনগনকে সম্পৃক্ত করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করব।”
নির্বাচনে বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কয়েকটি দেশ অভিনন্দন জানানোর বিষয়ে প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান বলেন, ‘‘ আমরা কুটনৈতিক শিষ্ঠাচারে বজায় রেখে কথা বলি… আওয়ামী লীগের মতো নয়। তিনটি দেশ সরকারের সঙ্গে দেখা করেছে অথবা সরকার একটি দেশকে নির্বাচনে জয়ের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে…বাংলাদেশের মানুষকেও তারা ধন্যবাদ জানায়নি। তারা বাংলাদেশের মানুষকে ধন্যবাদ জানায়নি, তারা তাদের আচরণ এবং কথা-বার্তার মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণ করে দিয়েছে যে, নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের মানুষের ওপর নির্ভর করে না, তারা যার ওপর নির্ভর করে এই নির্বাচনে অন্যায় ফলাফল ছিনিয়ে নিয়েছে তাতে কি দাঁড়াল?”
‘‘ আজকে আপনি যে প্রশ্নটি করেছে, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে। কিন্তু আমরা আমাদের চিন্তা-ধ্যানধারণা এবং বক্তব্য… আমরা গণতন্ত্রের বিশ্বাস করি, মানুষের শক্তিতে বিশ্বাস করি এবং দেশে-বিদেশে যারা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি, যারা আমাদের সঙ্গে থাকবে, আমরা তাদের সঙ্গে থাকব।”
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘ এই সরকার অবৈধ। তারা জনগনের ভোটের সরকারের আসেনি। গতকালের নির্বাচনে এটা আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে, তারা কিভাবে ভোটারবিহীন একটা নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করছে। এই নির্বাচন জনগন প্রত্যাখান করেছে, তারা বর্জন করেছে।”
‘ডামি নির্বাচন, ডামি অবজারভার’
মঈন খান বলেন, ‘‘ ৭ তারিখ কোনো নির্বাচন হয়নি, ডামি নির্বাচন কমিশন, ডামি প্রার্থী, ডামি ভোটার এবং সর্বশেষ ডামি অবজারভার নিয়ে একটা নাটক হয়েছে। ৭ তারিখ যে নাটকটা সাজিয়েছি সেই নাটকের ফলাফল তারা গতকাল রাত থেকে আজকেও ঘোষণা করছে। এটা কোনো নির্বাচন না। দেখুন তাদের যে নির্বাচনী অবজারভার যাদেরকে ভাড়া করে এনেছিলো তাদের মধ্যে একজন বিদেশী অবজারভার নিজেই বলেছেন, এটা কোনো নির্বাচন নয়। গণমাধ্যমেও তার বক্তব্যে এসেছে….।”
‘‘ ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে প্রহসনের ডামি নির্বাচন বর্জন সুস্পষ্টভাবে বিরোধী দলের দাবির প্রতি এদেশের গণমানুষের গণরায়। বাস্তবতা হচ্ছে যে, গতকাল এই নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শোচনীয় ও নৈতিক পরাজয় হয়েছে….এটাই হচ্ছে সত্য।”
তিনি বলেন, ‘‘সরকারের এই নাটকের প্রতি জনগনের কোনো আগ্রহ নেই। নির্বাচনের নামে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগ মারামারি করেছে, খুনাখুনিও হয়েছে। জোর করে ব্যালেটে সিল মারা আবার ভোট কেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। সারা দেশে ৪০ হাজারে ওপর ভোট কেন্দ্র ছিলো। একটা বা চারটা ভোট কেন্দ্র বন্ধ করে নির্বাচন কমিশন তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছে এটা হাস্যকর প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুই না।”
‘অবৈধ সরকার, গণপ্রতিনিধিত্ববিহীন সংসদ এবং বর্তমান মেরুদন্ডবিহীন নির্বাচন কমিশন’ দিয়ে বাংলাদেশে কোনোদিন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলেও মনে করেন মঈন খান।
‘ভাড়াটিয়া অবজারভারও বলেছে ভোট হয়নি’
স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘ আমরা যেটা চাই যে, জনগনের ভোটে নির্বাচিত, জনগনের প্রতি দায়বদ্ধ একটি সরকার প্রতিষ্ঠা এবং সেটার জন্য দরকার একটা অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন। সেটা হয় নাই। ফলে এই নির্বাচন জনগন প্রত্যাখান করেছে এবং যে পরিমান ভোটের উপস্থিতি দেখানো হচ্ছে এটা যে ভুঁয়া… এটা আপনারাও, সকল মিডিয়া বলেছে, সোশ্যাল মিডিয়া বলেছে, দেশ-বিদেশের ব্যক্তিরা সবাই বলেছেন। আর ভাড়াটিয়া অবজারভার পর্যবেক্ষকও বলেছেন।”
‘‘ বিএনপিসহ গণতন্ত্র পুণঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রত সব রাজনৈতিক দল… তাদের দাবি হলো যে, অবিলম্বে ৭ জানুয়ারির এই ডামি নির্বাচন বাতিল করতে হবে, শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করে তার অধীনে জাতীয় নির্বাচন করতে হবে, রাষ্ট্রের ওপর জনগনের মালিকানা প্রতিষ্ঠা এবং গুম-খুন-গায়েবি মামলা এবং পেশী শক্তি দিয়ে জনগনের আন্দোলন দমনকারী জুলুমবাজ সরকারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থপাচার আর সিন্ডিকেট করে জনগনের সমস্ত সম্পদ ও অর্থ লুন্ঠনকারী এই সরকারকে বিদায় করতে হবে। এই দাবিতে আমরা জনগন নিয়ে গণসংযোগ করব।”
‘নির্বাচন বর্জনে অসহযোগ ছিলো’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘ মূলত আমরা অসহযোগ… শব্দগুলো খেয়াল করবে… আমরা বলেছিলাম যে, নির্বাচনে ভোট না দেয়া, নির্বাচন বর্জন করা। এই অসহযোগ আন্দোলনটা নির্বাচনের উদ্দেশ্যে আমরা ঘোষণা করেছিলাম। তার জন্য আরও কিছু কাজ করতে বলেছি… তার আমরা সুস্পষ্টভাবে বলব।”
‘‘ মূলত আমরা নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে অসহযোগের আহ্বান জানিয়েছিলাম। এই ভোট বর্জন হয়েছে। আমরা গণতান্ত্রিক দল শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাস করি। আমরা এটাতে(নির্বাচন) বাধা দিতে যাইনি। তারা নিজেরা বাধা দিয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় গোলাগুলি করেছে, মানুষের প্রাণ ক্ষয় হয়েছে, আহত হয়েছে, ভাংচুর হয়েছে… সবই হয়েছে তারা তারা।”
তিনি বলেন, ‘‘ আজকে নিজেরা নিজেরা ডামি প্রার্থী বানিয়ে ৬৩জন ডামি স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতে। দেখেন। জাতীয় পার্টিকে ২৬টা আসন বন্টন করেছিলো তার মধ্যে ১১টাকে জিতছে, বাকিগুলো জিতে নাই। ১৪ দলীয় জোটে যে কয়টি দিয়েছিলো তার মধ্যে কিছু হেরে গেছে। অবাক লাগে তারা(সরকার) বলছে যে, ক্রেন দিয়ে টেনে তোলা যায় তাকে নমিনেশন দেয়া যায় না আরকি।”
‘‘ এখন দেখা যাচ্ছে যে, ক্রেন দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে কিছু লোককে তোলার তারা জয় পেয়েছে। আবার কাউকে কাউকে ক্রেন দিয়ে টেনে তোলা হয়নি… তারা পরাজিত হয়েছে। এটা কোনো নির্বাচন হলো? গণতন্ত্র, নির্বাচন, সংবিধান এগুলো নিয়ে রসিকতা করার কোনো অধিকার কারো নাই।”
কত লোক ভোট দিয়েছে বিএনপির সম্ভাব্য ধারণা জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘ আমার মনে হয় এটি আপনারা যেকোনো একজন রিকশাওয়াকে জিজ্ঞাসা করেন, যেকোনো একজন দোকাদারকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা যেকোনো একজন সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞাসা করেন তারা আমার মনে আপনারা ভালো জবাব দেবে।”
মঈন খান বলেন, ‘‘ সরকার ঠিক যত পারসেন্ট বলে দেবে নির্বাচন কমিশন ঠিক তত পারসেন্ট ঘোষণা করবে। এটা অর্থহীন একটা ফিগার হবে।”
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার সোমবার গুলশানের কার্যালয়ে নেতৃবৃন্দ প্রথম আসেন। গতকাল দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্ব জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত তুলে ধরতে এই সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমানও ছিলেন।