নিজস্ব প্রতিবেদক: ১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। প্রায় প্রতিটি নদীতে আন্তর্জাতিক নদী আইন লঙ্ঘন করে একপাক্ষিকভাবে ভারত উজানে বাঁধ দিয়েছে। বাস্তবতার প্রয়োজনে আমাদের সরকারকে বাংলাদেশের মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার তথা ন্যায্য নদী ব্যবস্থাপনা ও পানির হিসাব নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনে একাধিক দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত পানি ব্যবস্থাপনার বাস্তবায়ন চায় বাংলাদেশের মানুষ।
মঙ্গলবার ২৭ আগস্ট দুপুরে ঢাকায় এক মিছিল পূর্ব সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেন।
ছাত্রজনতার আন্দোলনে নিহত ও আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বক্তারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত রোববার জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন তাকে স্বাগত জানাই। পাশাপাশি অবিলম্বে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানান। সমাবেশ শেষে প্রেসক্লাবের সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন ১২ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা।
“ভারতীয় আগ্রাসন বন্ধ। ৫৪টি অভিন্ন নদীতে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবি। ভারতীয় পণ্য বিক্রয় বন্ধ এবং ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক” শীর্ষক জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ১২ দলীয় জোটের উদ্যোগে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম।
বাংলাদেশ এলডিপির অতিরিক্ত মহাসচিব তমিজ উদ্দিন টিটুর পরিচালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ১২ দলীয় জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মুফতি গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব এডভোকেট শাহ আহমেদ বাদল, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি- জাগপার সহসভাপতি রাশেদ প্রধান, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন মো. ফারুক রহমান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন পারভেজ, ইসলামী ঐক্য জোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুর রাকিব, ইসলামিক পার্টির মহাসচিব আবুল কাশেম ও নয়া গণতান্ত্রিক পার্টির সভাপতি মাস্টার এম এ মান্নান।
জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ডামি নির্বাচনের পর থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান জানিয়ে সারাদেশে লিফলেট বিতরণ করেছি। ভারতের সবচেয়ে বড় পণ্য শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়েছে। তাকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে দ্রুত শাস্তি হিসেবে ফাঁসি দেওয়া হোক। কারণ আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মারা বসে নেই। তারা নানাভাবে বিভিন্ন কৌশলে ষড়যন্ত্র করছে।
তিনি বলেন, আনসার বাহিনীর নামে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা উস্কানি দিয়েছে। আমরা সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করবো। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আমরা আছি। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে আমরা সন্তুষ্ট। কিন্তু অবিলম্বে আওয়ামী লীগের লুটপাট, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার করুন। দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। এরপর জনগণ তাদের পছন্দের সরকার গঠন করবে। আমরা চাই জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধের ঐক্য।
১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়েছে। আমরা মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারছি। কিন্তু শেখ হাসিনার পরাজয়ের বদলা নিতে তার প্রভু ভারত আগ্রাসন শুরু করেছে। তারা ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ার পর এবার ফারাক্কা বাঁধ খুলে দিয়েছে।ভারত কখনোই আমাদের বন্ধু হতে পারেনা। আসুন সবাই মিলে ভারতীয় পণ্য বর্জন করি এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াই।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মারা। তবে তারা না থামলে তাদের অস্তিত্ব দেশে থাকবেন না। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আহ্বান জানাই আপনারা আরও কঠোর হোন। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে আরও উদ্যোমী হোন। দ্রুত সম্ভব একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করুন।
জমিয়তের মুহিউদ্দিন ইকরাম বলেন, শেখ হাসিনার কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অহঙ্কারীদের বলবো- আপনারাও তার থেকে শিক্ষা নিন। অবিলম্বে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের মহাসমাবেশ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন তিনি। জুলাই-আগস্টে ছাত্রজনতার আন্দোলনে আহত নিহতদের সঠিক তালিকা নিরুপন করার দাবি জানান তিনি।
জাগপার রাশেদ প্রধান বলেন, ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিদায় হলেও তাদের প্রেতাত্মারা এখনও চক্রান্ত করছে। তবে দেশের মানুষকে স্বৈরাচার আর কখনো মেনে নেবে না। তার প্রমাণ শেখ হাসিনা। গণহত্যাকারী শেখ হাসিনাকে বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক দেশ ঠাঁই দেয়নি।
লেবার পার্টির লায়ন ফারুক রহমান বলেন, বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার আহমেদ ভারতের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে পোস্ট করেছিল। কিন্তু তাকে পৈচাশিক কায়দায় হত্যা করেছিল। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে বলবো- আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মারা এখনও ষড়যন্ত্র করছে। তাদেরকে কঠোরভাবে দমন করুন। কেননা পরাজিত শক্তি অর্থ ও উস্কানি দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষকে মাঠে নামিয়ে একের পর এক আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত করছে ।
মিছিল-পূর্ব সমাবেশে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ভারতকে আর বিশ্বাস করে না। ভারত কেবলই হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বন্ধু। ভারত কখনোই বাংলাদেশের মানুষের বন্ধু হতে চায়নি, বন্ধু হতে পারেনি। তারা আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনকালে এতটাই কর্তৃত্ব খাটিয়েছে যে তাদের ন্যায্য-অন্যায্য সকল চাওয়া পাওয়া আদায় করে নিয়েছে। শেখ হাসিনা নিজ মুখে বলেছে, আমি ভারতকে যা দিয়েছি ভারত তা কোনদিন ভুলতে পারবে না!! ভারতকে এতকিছু দিয়ে এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতাসীন থেকেও ভারতের কাছে নদী এবং পানির ন্যূনতম অধিকার আদায় করতে পারেনি! পেরেছে শুরু ভোট বিহীন নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য ভারতের সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা!!
তারা বলেন, ভারত অভিন্ন নদীতে বাঁধ দেওয়ার কারণে খরার সময় বাঁধগুলোর মাধ্যমে একতরফাভাবে পানি আটকে দেয় এবং নিজ দেশের বিভিন্ন স্থানে সেই পানি নিয়ে সেচ কাজে ব্যবহার করে। ফলে বাংলাদেশের কৃষকেরা খরার মৌসুমে পানির অভাবে সেচকার্য সম্পাদন করে কৃষি কাজ করতে পারে না। ভারত কর্তৃক প্রাকৃতিকভাবে চলমান নদী প্রবাহকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার ফলে বাংলাদেশে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
আমরা প্রস্তাবিত তিস্তা বহুমুখী প্রকল্প চালু করে উত্তর বঙ্গকে মরুকরণ থেকে রক্ষা করবো। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে দেশের প্রতিটি নদীকে সারাবছর পানি সংরক্ষণের জলাধার হিসেবে গড়ে তুলবো। ভারতের প্রতিটি বাঁধের বিপরীতে আমরাও বাঁধ নির্মাণ করবো। ভারত খরার সময় পানি আটকালে আমরা রিজার্ভ করে রাখা পানি দিয়ে সেচ ও কৃষি কাজ চালানোর ব্যবস্থা করব। বন্যার সময় ভারত বাঁধের দুয়ার খুলে দিলে সে পানি বাংলাদেশে আর ঢুকবে না বন্যা প্লাবন ভারতের মাটিতেই হবে।
আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়ে নদী আইন বাস্তবায়ন করে ভারতের অন্যায় আচরণের বিহিত করা হবে।
সম্প্রতি ভারত পূর্ব ঘোষণা ও সতর্কীকরণ ছাড়াই ত্রিপুরায় মধ্য-রাতে বাঁধের স্লুইসগেট খুলে দিয়েছে। হঠাৎ করে বাংলাদেশের ৬টি জেলায় লক্ষ লক্ষ অপ্রস্তুত মানুষ ভারতীয় পানির তোড়ে মহা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যায়।
বাংলাদেশের মানুষ মনে করছে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করায় নাখোস হয়ে ভারত বাংলাদেশকে সতর্ক না করে বিনা নোটিশে গভীর রাতে স্লুইসগেট খুলে দিয়েছে। যেটা খুবই অবিবেচনাপ্রসূত এবং অমানবিক কাজ হয়েছে। কেউ কেউ এমন আচরণকে ভারত কর্তৃক অঘোষিত ইনভারমেন্ট ওয়ার বিবেচনা করছে।
তারা আরও বলেন, লক্ষ লক্ষ বানভাসি মানুষকে উদাত্তচিত্তে সাহায্য ও সহায়তা করার জন্য সারাদেশের সামর্থ্যবান মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। ইতিমধ্যে সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠন প্রশাসন এবং সর্বস্তরের মানুষ বানভাসীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ইনশাআল্লাহ অচিরেই আমরা এই দুঃসহ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারব এবং আগামীতে বন্যা ও নদী ব্যবস্থাপনার স্থায়ী সমাধানের জন্য দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় যা যা করণীয় বাংলাদেশ তা করবে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, এবারে শুধু ভারতীয় পণ্য বয়কট নয়, বৈরী ভারতকে সর্বাত্মকভাবে বয়কট করতে হব। আমরা আর ভারতের কোন অবিবেচক আচরণ সহ্য করব না।
নেতৃবৃন্দ বন্যা দুর্গত মানুষদের পাশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্র জনতা এবং সকল পেশার মানুষকে এগিয়ে আসার জন্য অভিনন্দন ও মোবারকবাদ জানান। নেতৃবৃন্দ বলে, বাংলাদেশ যখন জেগে উঠেছে কোন বাধা এবং সমস্যাই এই জাতিকে দমিয়ে রাখতে পারবেনা