ঢাকা: গত ১৫ বছরে সংঘটিত বিভিন্ন গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন।
শনিবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দেওয়া কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে গুমের ঘটনায় জড়িতদের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুসহ র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে কমিশন।
এ বিষয়ে পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়। তাতে বলা হয়, ‘গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। এ ছাড়া হাসিনা প্রশাসনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার গুমের ঘটনায় সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
যাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশত্যাগ করেন। এর পরপর মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে তাঁকে জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত একাধিক হত্যার ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম ও ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ আত্মগোপনে রয়েছেন। তাঁরা বিদেশে চলে গেছেন বলেও প্রচার রয়েছে।
গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গতকাল বিকেল পাঁচটায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনটি জমা দেয়। তাতে বলা হয়, গুমের ঘটনায় কমিশনে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৭৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কমিশনের প্রধান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, গুমের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা কাজটি এমনভাবে করেছেন, যাতে এগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। বিভিন্ন বাহিনী নিজেদের মধ্যে ভিকটিম (তুলে নেওয়া ব্যক্তি) বিনিময় করেছে এবং পরিকল্পনা ভিন্ন ভিন্নভাবে বাস্তবায়ন করেছে। তিনি আরও জানান, গুমের শিকার অনেকে এখনো শঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না। তাঁদের ওপর এতটাই ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছিল যে তাঁরা এখনো ট্রমায় ভুগছেন।
‘প্রধান উপদেষ্টা তাঁর সর্বশেষ বক্তব্যে গুমের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও সঠিক বিচারের আশ্বাস দেওয়ার পর রিপোর্টের সংখ্যা অনেক বেড়েছে’ উল্লেখ করে কমিশনের সদস্যরা অধ্যাপক ইউনূসকে আয়নাঘর (গোপন বন্দিশালা) পরিদর্শনের অনুরোধ জানান। তাঁরা বলেন, ‘আপনি আয়নাঘর পরিদর্শন করলে ভিকটিমরা (ভুক্তভোগীরা) অভয় পেতে পারেন।’
প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের এ অনুরোধে সম্মতি দিয়ে জানান, স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল, যা আয়নাঘর নামে পরিচিতি পেয়েছে, সেগুলো দেখতে যাবেন। তিনি কমিশনের সদস্যদের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং কাজটি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, তাঁরা তিন মাস পর মার্চে আরও একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দেবেন। কাজটি শেষ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে কমপক্ষে আরও এক বছর সময় প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রধান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এবং কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদও উপস্থিত ছিলেন।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত করতে অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৭ আগস্ট এই কমিশন গঠন করে। কমিশনে র্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি, সিটিটিসি, সিআইডি, পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, কমিশন এখন পর্যন্ত যে ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেছে, তার মধ্যে ৭৩ শতাংশ ভুক্তভোগী ফিরে এসেছেন। বাকি ২৭ শতাংশ (অন্তত ২০৪ জন ব্যক্তি) এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন ৩ অক্টোবর তাদের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে জানায়, শেখ হাসিনা সরকারের সময় জোরপূর্বক মানুষকে তুলে নিয়ে গোপন বন্দিশালায় গুম করে রাখার প্রমাণ মিলেছে। ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিতি পাওয়া এ বন্দিশালার অবস্থান ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তরের চৌহদ্দির মধ্যে, যা একসময় জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি) হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
ওই সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এই কমিশন সুনির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্যে সিভিল কোর্ট হিসেবে কাজ করবে। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁদের তলব করা হবে।
সরকারি সূত্রগুলো জানায়, কমিশন প্রাপ্ত অভিযোগ ও তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে শেখ হাসিনা সরকারের সময় দায়িত্ব পালনকারী সামরিক ও বেসামরিক অনেক কর্মকর্তাকে ইতিমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে অনেকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাসহ উল্লিখিত ব্যক্তিদের বাইরে আর কার কার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে, সেটা এখনই প্রকাশ করতে রাজি নয় সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। কারণ, এর সঙ্গে ঘটনার শিকার ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত রয়েছে। পাশাপাশি সম্ভাব্য জড়িত ব্যক্তিরা পালিয়ে যেতে পারেন।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাক-এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম বলেন, এখন দরকার শেখ হাসিনাসহ গুমের ঘটনায় যাঁদের নাম এসেছে, দ্রুত তাঁদের বিচার নিশ্চিত করা। গুম হওয়া ব্যক্তিদের কারা তুলে নিল—তাঁদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করা। গুমের অনেক আলামত নষ্ট করা হয়েছে, আরও অনেক কিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনে কমিশনের সক্ষমতা বাড়িয়ে যত দ্রুত সম্ভব কার্যক্রম সম্পন্ন করে অপরাধীদের বিচার করতে হবে।