বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার বার্ষিক অধিবেশন ১১ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় সংগঠনের আমীর ডা. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে মগবাজার আল ফালাহ মিলানায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার-এর পরিচালনায় নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের ও মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন। আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য প্রদান করেন।
আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার অধিবেশনে এমন একটি সময় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যখন আমাদের প্রিয় জন্মভূমি এ বছরের ৫ আগস্ট একটা কাক্সিক্ষত পরিবর্তন উপহার পেয়েছে। দেশে-বিদেশে অংশগ্রহণকারী এই পরিবর্তনের মূল কারিগর, নায়ক ও সহযোদ্ধা বিশেষভাবে যারা তাদের মূল্যবান জীবন দিয়ে জাতির এই কাক্সিক্ষত পরিবর্তন এনে দিয়েছেন আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছি। আমি তাদের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করছি। এই পরিবর্তনে আমাদের অসংখ্য সহকর্মী ভাই-বোন, যুবসমাজ, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। অনেকে চোখ হারিয়ে চিরদিনের জন্য অন্ধত্ব বরণ করেছেন, অনেকে হাত হারিয়েছেন, অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। এখনো অসংখ্য ছাত্র-জনতা গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন। আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কষ্ট নিয়ে এখনো যারা বেঁচে আছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এবং মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করছি আল্লাহ তায়ালা যেন তাদেরকে দ্রুত সুস্থ করে দেন। শহীদ পরিবারের গর্বিত, সম্মানিত মর্যাদাবান সদস্যদের প্রতি আমরা গভীর সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছি। দেশের ভিতরে ও বিদেশের মাটিতে আন্দোলন করতে গিয়ে অনেকেই জেল-জুলুম এবং হয়রানির শিকার হয়েছেন। এখনও কোনো কোনো দেশের কারাগারে আমাদের নাগরিকেরা বন্দি অবস্থায় রয়েছেন। আমরা সরকারকে অনুরোধ করবো দ্রুততম সময়ের ভিতরে আমাদের ভিশনগুলোকে কার্যকর করে সরাসরি ঢাকা থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সাথে যোগাযোগ করে তাদেরকে তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করুন। তাদের সম্মানের সাথে দেশে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে।
তিনি আরও বলেন, গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে পতিত স্বৈরাচার সরকার জাতির সব অধিকার হরণ করেছিল। ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, কথা বলার অধিকার সর্বোপরি নিজের ভোটটি পছন্দের প্রার্থীকে দেয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অনেক প্রতিভাবান মানুষকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে দেয়ার পরিবর্তে অবসরে পাঠানো হয়েছে। কাউকে কাউকে আবার ওএসডি করে রাখা হয়েছে। আন্দোলনের পক্ষে থাকার কারণে বিরোধী দলের অসংখ্য নেতাকর্মীকে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। এই নৃশংস হত্যাকা- ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি বৈঠার তান্ডবতার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সেই হত্যা এবং ধ্বংসলীলা বাংলাদেশের জনগণ এবং বিশ^বাসী প্রত্যক্ষ করেছে। পতিত সরকারের কাছে জনগণের জান-মাল-ইজ্জত-আব্রুর কোনো মর্যাদা ছিলো না, কোন নিরাপত্তা ছিলো না। আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি পিলখানায় শহীদ ৫৭ জন চৌকস সেনা অফিসারকে। আল্লাহ তাদেরকেও শহীদের মর্যাদা দান করুন। এরপর আঘাতটা দেয়া হয়েছিলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উপর। দুইজন সাবেক আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযম (রহ.) ও শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (রহ.) সহ আমাদের ১১ জন্য সহকর্মীকে নির্মমভাবে বিচারের নামে প্রহসন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এর প্রতিবাদ তখনও করেছি এবং এখনও করছি। আমরা আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করি আল্লাহ যেন তাদেরকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন।
পতিত সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এত ক্ষতি অন্য কোনো দলের হয়নি। আমরা এ পর্যন্ত সারাদেশে পাঁচ শতের অধিক সহকর্মীকে হারিয়েছি। হাজার হাজার মামলা দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জেলে নেয়া হয়েছে। কার্যত আমাদের বাড়িই জেলে পরিণত হয়েছিল। জেলের ভিতরেও জেল, বাহিরেও জেল। গোটা দেশটাকেই একটা কারাগারে পরিণত করা হয়েছিল। অনেক বিবেকবান নিরীহ মানুষ এ তা-বের কারণে তখন দেশ ছেড়ে ভিন্ন দেশে ঠিকানা খুঁজে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনেক প্রতিভাবান সাংবাদিক তাদের বিবেকের জায়গা থেকে সত্য রিপোর্ট করার কারণে নিরাপদ থাকতে পারেননি। ফলে তাদেরকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। ২০১৩ সালে আমরা লক্ষ্য করেছি শাহবাগের কেন্দ্রস্থলে যে আসর বসানো হয়েছিল, যে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়েছিল, তখন দুইটি সরকার প্যারালাল চলছিল। একটা সরকার ছিল সংসদ কেন্দ্রিক আরেকটা সরকার ছিল শাহবাগ কেন্দ্রিক। শাহবাগের সরকার সংসদের সরকারের চাইতে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিল। তাদের কথায় জাতীয় পতাকা উঠত-নামত। জাতি বিস্ময়করভাবে এ সমস্ত বিশৃঙ্খলা লক্ষ্য করেছে।
এই সমস্ত ট্রমা নিয়ে জাতি কোনো রকমে বেঁচেছিল। তারা প্রত্যেকটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। আল্লাহর রাব্বুল আলামিন সাড়ে পনেরো বছরের এই জগদ্দল পাথর আমাদের সন্তানতুল্য ছাত্র-ছাত্রী, যুব সমাজের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট সরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এই সরিয়ে দেয়াটাও খুব সুখের ছিল না। কমবেশি দুই হাজার আদম সন্তানকে নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছে। স্থল থেকে খুন করা হয়েছে এবং আকাশ থেকেও গুলি করে খুন করা হয়েছে। এ যেন জাতির বিরুদ্ধে সরকারের যুদ্ধ ছিল। আমরাও তাদের সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি আরেকবার। তাদের সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে আজকের এই বাংলাদেশ। নতুন বাংলাদেশ। সুতরাং এ জাতিকে তাদের রক্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে এবং ঋণ পরিশোধের প্রতি যতœশীল হতে হবে। আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা আমাদের এই সন্তানদের নাগরিকদের রক্তের মর্যাদা দিতে চাই। এর বিনিময়ে তারা যে শ্লোগান দিয়েছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ আমরা ন্যায়বিচার সমৃদ্ধ একটি সমাজ চাই, বৈষম্যহীন সমাজ চাই। বৈষম্যহীন, ন্যায়বিচার সমৃদ্ধ সেই সমাজ গড়তে হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে কাউকে না কাউকে এ দেশের দায়িত্ব হাতে তুলে নিতে হবে। এ সুষ্ঠু নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা বর্তমান ইন্টেরিওর গভর্নমেন্টের কাছে দাবি জানিয়েছি যে, প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সমতল মাঠ তৈরি করুন। এর জন্য একটি রোডম্যাপ দিন। আমরা আরও বলেছি যে সংস্কারের এই মৌলিক বিষয়গুলো সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদক্ষেপ আপনাদের নিতে হবে। অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্যতম মৌলিক দুটি বিষয়ের একটি হলো- রাষ্ট্রের সকল প্রাপ্ত বয়ষ্ক নাগরিকদেরকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিগত সরকার জুলুম করে বহু জায়গায় তৎকালীন বিরোধীদলে যারা ছিলেন তাদের এলাকাগুলোকে টার্গেট করে আসন সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। তারা আসন পুনর্বিন্যাসের নামে জুলুম করেছে। এগুলোকে আবার পুনর্বিন্যাস করা লাগবে বিবেক ও বাস্তবতার আলোকে।
তিনি আরও বলেন, পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনের নামে প্রহসন করায় দেশের মানুষ ভোটের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। অসংখ্য যুবক-যুবতীর বয়স হয়েছে ভোট দেয়ার। কিন্তু তারা ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। নির্বাচনের প্রতি তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে। এজন্য আমরা যৌক্তিক সময় দেয়ার পক্ষে। বিলম্বত বা দীর্ঘায়িত্ব সময় নয়, যৌক্তিক সময় দিতে চাই। পাশাপাশি এই ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে প্রবাসী ভাইয়েরা আমাদের সাথে সমান তালে যুদ্ধ করেছেন। আমরা তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাদেরকেও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
প্রিয় দেশবাসী, দেশ যখন এই পরিবর্তনের ইতিবাচক ধারায় আছে তখন আমরা লক্ষ্য করছি, এই দেশকে অশান্ত করার জন্য পতিত স্বৈরাচার এবং তাদের দোসররা দেশে-বিদেশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। তারা আমাদের সমাজকে অস্থিতিশীল করতে চায়। আলহামদুল্লিাহ, বাংলাদেশের বিচক্ষণ দেশপ্রেমিক জনতা তাদের পালস বুঝতে পেরে তাদেরকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। তাদের ষড়যন্ত্র আল্লাহ তায়ালা ব্যর্থ করে দিয়েছেন। তাদের এই অপপ্রয়াস জাতিকে আরেকবার ঐক্যবদ্ধ হতে সহযোগিতা করেছে। আমাদের প্রতিপক্ষ যদি এটা বুঝতে পারেন, এই দেশের মানুষ আর কারো কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করবে না এবং কোনো রক্ত চক্ষুকে পরোয়া করবে না।
আমরা একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ মানবিক দেশ চাই। আমরা একটা দুর্নীতিমুক্ত দেশ চাই। সুবিচারপূর্ণ একটি সমাজ চাই। আমরা আমাদের যুবকদেরকে এদেশের উন্নয়নের কারিগর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব আমরা ক্রমান্বয়ে তাদের হাতে তুলে দিতে চাই। এমন রূপক বাংলাদেশ গঠনে, মানবিক বাংলাদেশ গঠনে আমরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের প্রতি সম্মান রেখে সকলকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। আমরা আশাবাদী প্রিয় দেশবাসীর সহযোগিতা পেলে একটা কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব। এজন্য আমরা দেশপ্রেমিক সকল জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই। জাতীয় স্বার্থের জায়গায় আমরা যেন বিভক্ত না হই, বরং আমরা যেন ঐক্যবদ্ধ থাকি। জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকলে জাতির বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করবে তারা অবশ্যই ব্যর্থ হবে। আল্লাহ তাদেরকে ব্যর্থ করে দিবেন ইনশাআল্লাহ।”