হিন্দু উগ্রবাদী সংগঠন ইসকনের সাবেক নেতা ও বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন শুনানিকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে তার অনুসারীদের সাথে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে । এ সময় আদালতের নিচতলায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা সাইফুল ইসলাম আলিফ (৩৫) নামে এক আইনজীবীকে পাশের জঙ্গল সিনেমা লেনে নিয়ে গিয়ে মারধরের পর কুপিয়ে হত্যা করেছে ।
গুরুতর আহত অবস্থায় মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) বিকেলে তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ মৃত ঘোষণা করেন।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থলেই হয়তো সাইফুল মারা যায়। হাসপাতালে নিয়ে আসার পরে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত্যু ঘোষণা করে।’’
ওই সংঘর্ষে আহত হয়ে সাত থেকে আটজন বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ।
তবে আহতের সংখ্যা আরো বেশি বলে পুলিশ জানিয়েছে।
আলিফ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকার জামাল উদ্দিনের ছেলে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের জানান, দিদার নামের এক যুবক ওই আইনজীবীকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এরপর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহতের লাশ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের লাশ ঘরে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আদালতের নিচতলায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা তাকে পার্শ্ববর্তী জঙ্গল সিনেমা লেনে নিয়ে গিয়ে মারধরের পর কুপিয়ে হত্যা করে।
এর আগে, মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) কোতোয়ালী থানার নিউমার্কেট মোড়ের স্বাধীনতা স্তম্ভে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে হওয়া মামলায় রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আদালতে হাজির করা হয়। তার পক্ষের আইনজীবীরা জামিন আবেদন করলে বেলা পৌনে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম ৬ষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক কাজী শরীফুল ইসলাম শুনানি শেষে জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেন।
এই আদেশের পরপরই এজলাসের বাইরে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের ভক্ত-অনুসারীরা। এরপর প্রায় আধঘণ্টা এজলাসের বাইরেই অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন তারা। বেলা সোয়া ১২টার দিকে তাকে এজলাস থেকে বের করে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে প্রিজনভ্যানে তোলা হলে প্রিজনভ্যানের সামনেই বসে বিক্ষোভ করতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা।
দুপুর ১২টার পরপরই আদালত প্রাঙ্গণে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন চিন্ময় কৃষ্ণের অনুসারী ও আইনজীবীদের একাংশ। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যকে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। প্রায় তিন ঘণ্টা তারা প্রিজনভ্যান আটকে রাখার পর বেলা ৩টার দিকে অ্যাকশনে যায় পুলিশ। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চিন্ময় দাসকে আদালতে হাজির করা নিয়ে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়। সকাল থেকে আদালত পাড়ায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ, বিজিবি ও আর্মড পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। এ সময় আদালতে ঢুকতে কড়াকড়ি আরোপ করা হলে সনাতনী সম্প্রদায়ের আড়ালে আদালত ও আশপাশের এলাকায় পরিকল্পিতভাবে সমাগম হয় পতিত আওয়ামী ক্যাডাররা। ফলে আদালত চিন্ময় কৃষ্ণের জামিন নামঞ্জুর করার সাথে সাথে তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং সেখানে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। ভাংচুর চালানো হয় নির্বিচারে। মসজিদে হামলা করা হয় এবং নিরীহ মুসল্লিদের আহত করা হয়। সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিতে মুসলমানদের উদ্দেশ করে গালিগালাজ এবং হামলার জন্য তার্গেট করা হয়। পাশাপাশি তারা প্রিজনভ্যান আটকে চিন্ময় কৃষ্ণকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে। এ সময় তারা ‘জয় শ্রীরাম’, ‘দালালের গালে গালে, জুতা মারো তালে তালে’, ‘জেলের তালা ভাংব, চিন্ময় প্রভূকে আনবো’, ‘কুরুক্ষেত্রের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’ এসব স্লোগান দিতে থাকেন। তাদের পরিকল্পিত উস্কানিমূলক তৎপরতার মাঝেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল একেবারেই শান্ত। তাদের বুঝিয়ে সরে যেতে বলে। কিন্তু কোনো কিছুতেই যেন কাজ হচ্ছিল না। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মৃদু লাঠিপেটা করে এবং গ্যাস গান ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
ইত্যবসরে সনাতনীর আড়ালে সেখানে হাজির হওয়া আওয়ামী ক্যাডাররা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে এবং সাধারণ পথচারীদের বেছে বেছে হামলা করতে থাকে। একপর্যায়ে রঙ্গম টাওয়ারের সামনের গলির মুখে অ্যাভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফকে উপর্যুপরি কোপাতে থাকে এবং শরীর থেকে পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তাকে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় চমেক হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
উল্লেখ্য, কোতোয়ালী থানার নিউমার্কেট মোড়ের স্বাধীনতা স্তম্ভে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে হওয়া মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে সোমবার (২৫ নভেম্বর) বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
এরপর মঙ্গলবার ভোরে তাকে চট্টগ্রাম নেয়ার পর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারপর বেলা ১১টার দিকে তাকে চট্টগ্রাম আদালতে নেয়া হয়।
এ মামলায় চিন্ময় দাসসহ ১৯ জনকে আসামি করা হয়। মামলার আসামিরা হলেন পুণ্ডরীক ধাম মন্দিরের অধ্যক্ষ চন্দন কুমার ধর প্রকাশ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী, চট্টগ্রামের হিন্দু জাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক অজয় দত্ত (৩৪), নগরীর প্রবর্তক ইসকন মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলা রাজ দাশ ব্রহ্মচারী (৪৮), গোপাল দাশ টিপু (৩৮), ডা. কথক দাশ (৪০), প্রকৌশলী অমিত ধর (৩৮), রনি দাশ (৩৮), রাজীব দাশ (৩২), কৃষ্ণ কুমার দত্ত (৫২), জিকু চৌধুরী (৪০), নিউটন দে ববি (৩৮), তুষার চক্রবর্তী রাজীব (২৮), মিথুন দে (৩৫), রুপন ধর (৩৫), রিমন দত্ত (২৮), সুকান্ত দাশ (২৮), বিশ্বজিৎ গুপ্ত (৪২), রাজেশ চৌধুরী (২৮) এবং হৃদয় দাস (২৫)। রিমন দত্ত (২৮), সুকান্ত দাস (২৮), বিশ্বজিৎ গুপ্ত (৪২), রাজেশ চৌধুরী (২৮) ও হৃদয় দাস (২৫)।
মামলার এজাহারে বাদী অভিযোগ করেন, গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পর নগরের নিউমার্কেট মোড়ের জিরো পয়েন্টে স্তম্ভের ওপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা একটি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে, যা এখনো সেখানে রয়েছে। ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের উদ্যোগে লালদীঘির মাঠে একটি মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজারো মানুষ ওই সমাবেশে যোগ দেন। ওই দিন চন্দন কুমার ধরসহ ৯ জন আসামির ইন্ধনে বাকি আসামিরা নিউমার্কেট মোড়ের জিরো পয়েন্ট স্তম্ভ ও আশপাশে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ওপর ধর্মীয় গোষ্ঠী ইসকনের গেরুয়া রঙের ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করে সেখানে স্থাপন করে দেন। এ নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।