ঢাকা: রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনসমূহ আগামী ১ অক্টোবর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করবে এবং পরবর্তী তিন মাস অর্থ্যাৎ ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিশন তার সংস্কার প্রস্তাবনা সরকারের নিকট উপস্থাপন করবে। কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, ছাত্র প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করবে।
বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ৬ সংস্কার কমিশনের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে এসব সিদ্ধান্ত হয়।
রাজধানীর তেজগাঁও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি মাহফুজুল আলম এসব কথা বলেন।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘কমিশনগুলো ১ অক্টোবর থেকে তাদের কাজ শুরু করবে এবং আশা করছি ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তারা একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দ্বিতীয় ধাপে উপদেষ্টামণ্ডলী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু করবে।
’
তিনি জানান, এরপর আরো বৃহৎ আকারে আলোচনা হবে যেখানে সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পরে সেগুলো অনলাইনে উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে, যাতে সকলে তাদের মতামত পাঠাতে পারেন।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খার কথা উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা শুধু নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সেটা ছিল একটা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন এবং প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন।
বাংলাদেশে যেন আর কোনোদিন, কখনো যেনো ফ্যাসিবাদী শাসন জাঁকিয়ে বসতে না পরে সেটা রোধ করতে কী কী সংস্কার প্রয়োজন সে লক্ষ্য নিয়ে সংস্কার কমিশন প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করেছে।’
সংস্কার কমিশনের কর্মপদ্ধতির বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজুল আলম বলেন, ‘দেশের মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে ফ্যাসিবাদী শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ঠ ছিল। এখন জনগণের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি যেমন আছে, তেমনি গত ১৫ বছরে দেশের সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো জনগণের স্বার্থে কাজ করতে পারছে না। এগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৬ টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে।
কমিশনগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করবে। তাদের ওপর কোনো রকম রাজনৈতিক চাপ না থাকবে না।’
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কমিশনের প্রধানদের বৈঠকের বিষয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আরো বলেন, ‘বৈঠকে প্রধানত আলোচনা হয়েছে সংস্কার ভাবনা নিয়ে। কমিশনগুলো কীভাবে কাজ করতে চায়, কর্মপদ্ধতি কী হবে, সদস্য বাছাইয়ের প্রক্রিয়া কী হবে, কবে প্রতিবেদন দেবেন, রাজনৈতিক দল বা পেশাজীবী সংগঠনের অংশগ্রহণ কীভাবে হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীলীগ ও তার দোসরা ছাড়া অন্য সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের পরামর্শ সংস্কার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ গণহত্যাকারী ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। আমাদের প্রায় অন্তত এক হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। আরো অনেক মানুষকে গুরুতর আহত করেছে, চক্ষুহীন-দৃষ্টিহীন করেছে। যারা বিচারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হবে না। তাদের বাদে সমাজের যত প্রতিনিধিত্বকারী শ্রেণি আছে, রাজনৈতিক দল আছে, সামাজিক, পেশাজীবী, ছাত্র সংগঠন, বিপ্লবী অভ্যুত্থানে ছিলেন- তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে যতভাবে পারা যায় মতামত প্রতিফলিত করা হবে।’
অতীতের কমিশনের রিপোর্টগুলোও এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
গণহত্যার বিচারের মুখোমুখি করতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ভারতের বন্দী বিনিময় চুক্তি আছে। সেখানে যদি কোনো সাজাপ্রাপ্ত আসামি থাকেন, উনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা যা-ই হোন না কেন, উনার প্রত্যার্পন আমরা চাইতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অন্দোলনের সময় যে গণহত্যা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, সেটার বিচারের লক্ষ্যে আমরা পদক্ষেপ বেশ কিছু ইতিমধ্যে নিয়েছি। ট্রাইব্যুনালে চীফ প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং অচিরেই আদালত পুর্নগঠন করা হবে। পূর্ণাঙ্গভাবে বিচার কার্যক্রম শুরু হলে সরকার শেখ হাসিনার প্রত্যার্পণ চাইবে।’
সংবিধান সংশোধন কী প্রক্রিয়ায় হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে আসিফ নজরুল বলেন, ‘সংস্কার কমিশন সকল সম্ভাবনা পর্যালোচনা করবে। সেটা গণভোট কিংবা গণপরিষদের মাধ্যমে হতে পারে। গণপরিষদ সংবিধান তৈরি করতে বা গ্রহণ করতে পারে। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নের কাজ চলতে পারে। কী হবে সে সিদ্ধান্ত আমরা নেব না, সেটা নেবে বাংলাদেশের জনগণ। জনগণের পক্ষে কাজ করার জন্য এ কমিশন গঠন করা হয়েছে। সেখানে সমাজের সকল স্তরের মানুষের মতামতের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হবে।’
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা একটা কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনে ছিলাম। বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হয়েছি। ভোটাধিকার থেকে শুরু করে বহুক্ষেত্রে বঞ্চনা। এটার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে এ জন্য কতগুলো পরিবর্তন আনতে হবে। কতগুলো সংস্কার করতে হবে।’