ভারতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সাধারণ নির্বাচনে আজ শুক্রবার (১৯ এপ্রিল-২৪) ভোট গ্রহণ শুরু হচ্ছে। ছয় সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচনে ভোটার প্রায় ১০০ কোটি। নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তৃতীয় মেয়াদে বিজয়ী হবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, তাঁর বিজয়ে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে কর্তৃত্ববাদ ও হিন্দুত্ববাদ আরও গেড়ে বসতে পারে।
অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফায় আজ ১ হাজার ৬২৫ প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ হবে। ভোট গ্রহণ শুরু সকাল ৭টায়, শেষ হবে সন্ধ্যা ৬টায়। বিরোধীদের আপত্তি সত্ত্বেও ভোট নেওয়া হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। সাত দফায় আগামী ১ জুন পর্যন্ত ভোট শেষে ফল প্রকাশ হবে ৪ জুন। এবার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে ২ হাজার ৬০০টি রাজনৈতিক দল।
প্রথম দফায় যে কেন্দ্রগুলোতে নির্বাচন হতে চলেছে, তার প্রচারণা শেষ হয়েছে বুধবার সন্ধ্যায়। প্রধানমন্ত্রী মোদি, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদবসহ বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতারা তাদের দলীয় প্রার্থীদের হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন।
এরই মধ্যে ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে গেছেন ভোটের কর্মীরা। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রগুলোতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান মোতায়েনের পাশাপাশি কুইক রেসপন্স টিম, হেভি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড, ওয়েবক্যাম, ড্রোনের মাধ্যমেও ভোট প্রক্রিয়ার ওপর নজর রাখবে নির্বাচন কমিশন।
এবার ভারতে যোগ্য ভোটার ৯৭ কোটি, যা বিশ্বের জনসংখ্যার ১২ শতাংশ বা উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি।
বেশির ভাগ রাজনৈতিক জরিপ অনুসারে, প্রধানমন্ত্রী মোদিই সবচেয়ে এগিয়ে। তিনি গত এক দশকে দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি পুনর্নির্মাণ করেছেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদী নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ধর্মনিরপেক্ষতাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারত দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। দেশটির নির্বাচনের ফল আন্তর্জাতিকভাবেও প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ বহু দেশের জন্য ভারত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছে। চীনকে মোকাবিলায় দিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছে তারা।
২০১৯ সালের সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে ভারতের ৫৪৩টি আসনের মধ্যে মোদির হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি জিতেছিল ৩০৩টি; কংগ্রেস জিতেছিল ৫২টি। বাকি আসন পেয়েছিল অন্য দলগুলো। এবার বিজেপি এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে, দলটি ৪০০টির বেশি আসন জয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা তাঁকে ভারতের ৮০ শতাংশ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে।
অন্যদিকে, মোদির শাসনে গত ১০ বছরে ভারতের বিরোধী দলগুলো শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় সংস্থার ক্রমাগত আক্রমণের শিকার হয়েছে। এতে তাদের অবস্থান ভীষণভাবে দুর্বল হয়েছে। তা সত্ত্বেও মোদিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে কংগ্রেসসহ ২৭টি বিরোধী দল গত বছর ‘ইন্ডিয়া’ নামে জোট গঠন করে।
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এবং এ জোটের অন্যতম প্রধান নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গত মাসে দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। একে বিরোধীদের বিরুদ্ধে সরকারের দমনপীড়নের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তিনি এখনও কারাগারে। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস দাবি করেছে, মোদি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন কর কর্তৃপক্ষ দলটির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছে।
বিরোধীরা বলছেন, মোদির প্রতি সমর্থন আহামরি নয়। তাঁর দল ২০১৯ সালের নির্বাচনে মাত্র ৩৭ শতাংশ ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। বিজেপি ‘হিন্দি বেল্ট’ নামে পরিচিত জনবহুল উত্তরের প্রদেশগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করেছে। তবে দলটি পূর্ব ও দক্ষিণের অনেক রাজ্য, বিশেষ করে কেরালা ও তামিলনাড়ুতে সুবিধা করতে পারেনি। সেখানে আঞ্চলিক রাজনীতি শক্তিশালী; সমাজ ধর্মীয়ভাবে সংহত এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি প্রবল নয়। এবারের নির্বাচনে তাই বিজেপি দক্ষিণের আসন জয়ের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।
নির্বাচনে বিরোধীরা মোদির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে বিষয়গুলো পুঁজি করার চেষ্টা করছে, তা হলো কর্মসংস্থানের অভাব, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি দরিদ্র ভারতীয়দের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। মোদির নীতির বিরুদ্ধে কৃষকদের মধ্যেও ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মোদির শাসনে ভারতে স্বাধীন ও সমালোচনাকারী গণমাধ্যমের ওপর দমনপীড়ন চলছে। তাই দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ খবরেই মোদিকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও হুমকির মুখে।
দেশটির নির্বাচন কমিশন এক সময় বিশ্বে প্রশংসিত হলেও এখন এর স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ। বিরোধী দলের সংসদ সদস্য কপিল সিবাই বলেন, ‘মনে হচ্ছে, গত ১০ বছরে নির্বাচন কমিশন সরকারের একটি বর্ধিত হাত হয়ে উঠেছে।’
অনেকে বিশ্বাস করেন, ক্ষমতাসীন বিজেপি বড় ধরনের জয় পেলে দলটি তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার মূল নীতিগুলো আরও কার্যকর করার জন্য দ্রুত অগ্রসর হবে। এর মধ্যে রয়েছে সারাদেশে অভিন্ন নাগরিক বিধি কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি, যা সংখ্যালঘুদের স্বাধীনভাবে ধর্ম ও সংস্কৃতি পালনের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যরা আশঙ্কা করছেন, তৃতীয় মেয়াদের বিজেপি সরকার আরও কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠবে।
তবে বিরোধীদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো, বিজেপি প্রত্যাশিত ৪০০ আসনে জয় পেলে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান সংশোধন করে দেশটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে।