ডেস্ক রিপোর্ট: আনুষ্ঠানিকভাবে আরো একবার ভেঙেছে প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দলটির মধ্যে অসন্তোষের পর আনুষ্ঠানিক সম্মেলন করে নতুন কমিটি ঘোষণা করেছেন দলের একাংশের নেতারা।
শনিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে এরশাদ পত্নী রওশন এরশাদকে।
হুইল চেয়ারে এসে সম্মেলনে যোগ দিয়ে রওশন এরশাদ বলেছেন, ‘আদালতের রায় অনুযায়ী দলীয় প্রতীক লাঙ্গল আমার।’
এরপরই প্রশ্ন উঠছে, কোনটি জাতীয় পার্টির মূল অংশ?
আর দলীয় প্রতীক কী লাঙ্গল হাতছাড়া হতে যাচ্ছে জিএম কাদেরের জাতীয় পার্টির?
জিএম কাদের অংশ অবশ্য বলছে, রওশন এরশাদের জাতীয় পার্টির আইনগতভাবে লাঙ্গল প্রতীক পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
জাতীয় পার্টি জিএম কাদের অংশের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বিবিসি বাংলাকে বলেন, জাতীয় পার্টি ও লাঙ্গলের নিয়ন্ত্রণে সব কিছু নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেয়া আছে। এখন অন্য কেউ গিয়ে বললেই তারা লাঙ্গলের মালিক হতে পারবে না।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বিবিসি বাংলাকে বলেন, শুধুমাত্র দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন করা হলে দলীয় প্রতীক তাদেরকে দিতে পারবে নির্বাচন কমিশন। তা না হলে এই সিদ্ধান্ত দিতে হবে আদালতের।
গত মাসে জাতীয় পার্টির রওশনপন্থীরা দলীয় চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেয়।
তবে বিষয়টি দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী না হওয়ায় ইসি তাদের আবেদন নামঞ্জুর করে।
জাতীয় পার্টির রওশন অংশের নতুন মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, রওশন এরশাদ যেখানে থাকবে লাঙ্গল প্রতীকও সেখানে থাকবে। হাইকোর্টের রায়ও আছে। এখন যদি আমরা লাঙ্গল নাও পাই পাঁচ বছর পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব।
যেভাবে হলো রওশনপন্থীদের সম্মেলন
শনিবার সম্মেলনে যোগ দিতে সকাল থেকে সারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা রওশনপন্থীরা আসেন ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে।
সম্মেলন উপলক্ষে মৎস্য ভবন মোড় থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটক পর্যন্ত ছিল রওশনপন্থীদের শোডাউন। তারা এরশাদ এবং রওশনের ছবি-সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে আসেন।
সম্মেলনে আমন্ত্রণ করা হলেও আওয়ামী লীগের কেউ এতে আসেননি।
তবে উপস্থিত ছিলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী, জেপির মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম-সহ কয়েকটি ছোট দলের নেতারা। ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত কয়েকটি দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারাও। সম্মেলন ঘিরে নিরাপত্তা ব্যাপক জোরদার করে আইনশৃংখলা বাহিনী।
দুপুর ১২টায় সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার সভাপতিত্বে কাউন্সিল শুরু হয়। এতে চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদের নাম প্রস্তাব করেন জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর।
একই সময় দলীয় মহাসচিব হিসেবে কাজী মামুনুর রশীদের নাম প্রস্তাব করেন গোলাম সারোয়ার মিলন। উপস্থিত কাউন্সিলর এবং ডেলিগেটরা এতে সমর্থন জানান।
এই সম্মেলনে নির্বাহী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন কাজী ফিরোজ রশিদ। তিনি এর আগে জিএম কাদেরপন্থী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।
নতুন এই কমিটিতে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান হয়েছেন সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, এছাড়া কো-চেয়ারম্যান হয়েছেন সাহিদুর রহমান টেপা, শফিকুল ইসলাম, রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ, গোলাম সারোয়ার মিলন ও সুনীল শুভ রায়।
জাতীয় পার্টি রওশন অংশের মহাসচিব কাজী মামুনুর রশিদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমরা জিএম কাদের কিংবা চুন্নু সাহেবদের দল থেকে বাদ দেই নাই। তাদেরকে উপদেষ্টা পরিষদে রাখা হবে।
এই সম্মেলনে জাতীয় পার্টির ১৩ জন সংসদ সদস্যের কেউ অংশ নেননি। ছিলেন না সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা-সহ জিএম কাদেরপন্থী নেতাদেরও কেউ।
জিএম কাদের অংশের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বিবিসি বাংলাকে বলেন, এই সম্মেলনে যারা গেছে তারা সবাই দল থেকে বহিষ্কৃত ও অব্যহতিপ্রাপ্ত। সক্রিয়ভাবে যারা জাতীয় পার্টি করে তাদের কেউ যায়নি।
বার বার ভাঙছে জাতীয় পার্টি
সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়া হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৬ সালে গঠন করেন জাতীয় পার্টি।
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদের পতনের পর আর ক্ষমতায় যেতে পারেনি দলটি। তবে বেশ কয়েকবার ভাঙনের মুখোমুখি হতে হয় দলটিকে।
সর্বশেষ চলতি বছর দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে সরকারের সাথে সমঝোতার পরও দলটি মাত্র ১১টি আসনে জয়লাভ করে।
এতে দলের অনেক সিনিয়র নেতা মনোনয়ন-বঞ্চিত হন। কেউ কেউ আবার দলীয় মনোনয়ন পেয়েও পরাজিত হন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে।
এরপরই দলের মধ্যে সংকট তৈরি হয়। গত ২৮ জানুয়ারি জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন এরশাদ পত্নী বেগম রওশন এরশাদ। গত শনিবার সম্মেলনের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয় কমিটি।
তবে ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর দলের নেতৃত্ব নিয়ে টানাপড়েন তৈরি হলেও তখনো এতটা সংকটে পড়তে হয়নি দলটিকে।
জাতীয় পার্টি প্রথমবার ভাঙে ১৯৯০ এরশাদ সরকারের পতনের আগেই। তখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা টের পেয়ে জাতীয় পার্টির প্রথম মহাসচিব ডা: এম এ মতিন-সহ বেশ কয়েকজন দল থেকে বেরিয়ে যান।
যদিও তার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (প্রতীক কাঁঠাল) গঠিত হয় অনেক পরে।
পরবর্তীতে জাতীয় পার্টি প্রথম ভাঙনের মুখে পড়ে ১৯৯৬ সালে। তখন এরশাদ বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যোগ দিলে তৎকালীন মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জাতীয় পার্টি থেকে সরে গিয়ে নতুন দল গঠন করেন। সেই দলের নাম হয় জাতীয় পার্টি-জেপি।
এরপর ১৯৯৯ সালে এরশাদের জাতীয় পার্টি চারদলীয় জোট ছেড়ে দিলে তখনকার মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জু এরশাদের জাতীয় পার্টি ছেড়ে নতুন দল গঠন করেন। তার দলের নাম হয় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি।
২০১৪ সালে দশম জাতীয় নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি অংশ নেয়ার ঘোষণা দিলে সাবেক মহাসচিব কাজী জাফর আহমেদ আলাদা দল গঠন করে বিএনপি জোটে থেকে যান। এই দলটির নাম হয় জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর)।
নতুন করে দলের ঘোষণা দেয়ার পর রওশন অংশের মহাসচিব কাজী মামুনুর রশিদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, জিএম কাদের ও চুন্নু সাহেব জাতীয় পার্টিকে চরমভাবে ধংস করেছে। রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টিকে ধংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন এই সম্মেলনের মাধ্যমে।
লাঙ্গল নিয়ে টানাটানি
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এরশাদ জীবিত থাকা অবস্থায় প্রায় প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে দলে সংকট তৈরি হয়েছে। ভেঙ্গেছেও বেশ কয়েকবার। এখন নির্বাচন কমিশনে জাতীয় পার্টির বিভিন্ন অংশের নামে চারটি দল নিবন্ধিত রয়েছে।
২০১৯ সালের এরশাদের মৃত্যুর আগে জাতীয় পার্টি বার বার ভাঙলেও লাঙ্গলের নিয়ন্ত্রণ ছিল এরশাদের হাতেই। তবে এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টিতে জিএম কাদের ও রওশনপন্থীদের মধ্যে টানাপড়েন চলছেই।
জিএম কাদেরের হাতে দলীয় নেতৃত্ব থাকলেও গত চার বছরে বেশ কিছু নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছিলেন এরশাদ পত্নী রওশন এরশাদ। কিন্তু তা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী না হওয়ায় সে সব মনোনয়ন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে দলের ভরাডুবির পর রওশনপন্থীরা চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি দিয়ে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশনে।
পরে নির্বাচন কমিশন তাদের চিঠি দিয়ে জানায়, তাদের অপসারণ প্রক্রিয়া গঠনতন্ত্র অনুযায়ী না হওয়ায় ওই আবেদন নামঞ্জুর করা হয়েছে।
এরপরই গত শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন করে নতুন কমিটি ঘোষণা করেন রওশনপন্থীরা। নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে রওশন এরশাদ দাবি করেন দলীয় প্রতীক লাঙ্গল তার।
শনিবার রওশন এরশাদ বক্তৃতায় বলেন, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর লাঙ্গল প্রতীক ধরে রাখতে আদালতে দাঁড়াতে হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেই সময় এরশাদ ও আমাকে লাঙ্গল প্রতীক দিয়েছিলেন। এখনো লাঙ্গল জাতীয় পার্টির আছে, আগামীতেও থাকবে।
তবে মুজিবুল হক চুন্নু বিবিসি বাংলাকে বলেন, আগে ভাঙার পর যা হয়েছে, এবারো নতুন কিছু হবে না। যারা দল নিয়ে এগুলো করছে তারা হয়তো আমাদের চাপে ফেলার জন্য করতে পারে। আমরা দলীয়ভাবে সব নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী মনোনয়ন দেই। সামনেও দেবো।
জাতীয় পার্টির জিএম কাদের অংশ বলছে, দলের মূল অংশ হিসেবে তারাই নির্বাচন কমিশনের সাথে যোগাযোগ রাখছেন। সে সব তথ্য নির্বাচন কমিশনের তথ্য ভাণ্ডারে আছে। তাদের বক্তব্য, চাইলেই কেউ নির্বাচন কশিনের নিয়ম ভাঙতে পারবে না।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বিবিসি বাংলাকে বলেন, দলীয় প্রতীক বরাদ্দ কিংবা যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে গঠনতন্ত্রে যে কয়জন প্রেসিডিয়াম মেম্বারের সাপোর্ট লাগে সেই অনুযায়ী যদি রওশনপন্থীরা তথ্য জমা দেন তাহলে নির্বাচন কমিশন তার আইন অনুযায়ী বিবেচনা করবে। সূত্র : বিবিসি